শাকিল আহেমদ : আমাদের দেশে ‘দালাল’ শব্দটি একটি ভয়ঙ্কর শব্দ। ন্যায়ভাবে হোক আর অন্যায়ভাবে হোক, কাউকে দালাল বললে তার মাথার চান্দি গরম হয়ে যায়। ঝগড়াঝাটির সময় প্রতিপক্ষকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য অনেক সময় দালাল বলে কটূক্তি করা হয়। মূলত দালালি এক ধরনের পেশা। দালালদের কাজ হচ্ছে কোনো গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের সাথে গোপন যোগসাজশে কমিশনের মাধ্যমে সমাজের সহজ-সরল মানুষকে ভুল বুঝিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা। এক হিসেবে এরা এক ধরনের প্রতারক। আর এ প্রতারকদের সবাই ভয় পায়।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন সময় জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ওইসব দপ্তরে কোনো তথ্য জানতে গেলে দপ্তরসমূহের দেয়ালে ‘দালাল হতে সাবধান, দালালের খপ্পরে পড়বেন না’ ইত্যাদি সাইনবোর্ড সাঁটানো থাকে। ওইসব প্রতিষ্ঠানে দালাল দৃশ্যমান না হলেও বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলো দালালদের দখলে। সব সময়ই দালালদের পদচারণায় মুখরিত থাকে সেবাদানকারী এ প্রতিষ্ঠানটি। দেশের নামিদামি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের দালালদের বিভিন্ন কাহিনি নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন আমরা প্রায়ই পত্রিকার পাতায় দেখে থাকি। আর আমাদের মঠবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিও এর ব্যতিক্রম নয়। দালালদের আনাগোনা এ হাসপাতালের নিত্যসঙ্গী। সকাল ৯টা বাজার আগেই দালালদের পদচারণায় মুখরিত থাকে এ হাসপাতাল। বিড়ি-সিগারেটের গায়ে যেভাবে লেখা থাকে ‘ধূমপানে বিষপান, ধূমপান মৃত্যু ঘটায়’, ঠিক তেমনিভাবে মঠবাড়িয়া সরকারি হাসপাতালের নতুন ভবনের আউটডোরের টিকিট কাউন্টারের সামনের গ্রিলেও একটি ট্রানজিস্টার (রেডিও) ঝুলানো আছে। সেটি সারাক্ষণই বলতে থাকে, ‘হাসপাতালে দালাল প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, দালাল থেকে দূরে থাকুন, দালালমুক্ত হাসপাতাল গড়ুন এবং সম্ভাব্য সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা হাসপাতালে করুন। আদেশক্রমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।’ এই ট্রানজিস্টরটি সম্ভবত মাস দেড়েক আগে ওই গ্রিলে ঝুলানো হয়েছে। এর আগে ওটা ওখানে ছিল না। এটি ঝুলানোর পর প্রথম যেদিন আমি হাসপাতালে গেলাম টিয়াপাখির মতো ওর বুলি শুনতে পেলাম। মনে মনে চিন্তা করলাম হাসাপাতাল কর্তৃপক্ষ দালালদের ব্যাপারে এবার খুব কঠোর অবস্থানে। এর ৩-৪ দিন পর আবার সকালবেলা হাসপাতালে গেলাম। গিয়ে দেখি টিয়াপাখি ওর বুলি বুলছে আর দালালরা তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে মঠবাড়িয়া হাসপাতালে চিকিত্সক সংকট চলছে। যার কারণে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (এসএসিএমও) দিয়ে হাসপাতালের আউটডোর পরিচালনা করা হয়। হাসপাতালের নতুন ভবনের ডাক্তারদের কক্ষের ভিতর প্রবেশ করেই দেখি চিকিত্সকের চেয়ারে এসএসিএমও’র এক দিদি বসা। তার দু’পাশে দুজন দালাল বসে আছে। একজন পুরুষ। অন্যজন মহিলা। আমাকে দেখে দিদি একটু মুচকি হাসি দিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এরা কারা। দিদি জবাবে বললেন, রোগী নাই তো তাই একটু কথা বলছি। পাশের কক্ষে গিয়ে দেখি সেখানে এক আপা বসে আছেন। তাকে ওষুধ কোম্পানির এক প্রতিনিধি ভিজিট করছে। ব্যাপারটা দেখে মনে হলো ঘরের দরজা খোলা রেখে থানায় গিয়ে ওসি সাহেবকে ধমক দেয়া, আমার ঘরে চোর ঢুকেছে। দালালদের পাশের চেয়ারে বসিয়ে গল্পগুজব, রীতিমত কমিশন আদায় সবকিছুই ঠিকঠাকমতো চলছে। আর জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের লোকজন অথবা সাংবাদিকদের দেখলেই ‘আপনারা দালালদের বিরুদ্ধে একটু ব্যবস্থা নিন’। হাসপাতাল থেকে দালাল তাড়ানোর দায়িত্ব কাদের! জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, প্রশাসন, না পুলিশ প্রশাসনের! দালালদের মাধ্যমে যে সকল রোগী ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যায় এর ৪০ পার্সেন্ট রেফারেল ফি কারা পান! চিকিত্সক না অন্য কেউ! এই আধুনিক যুগে সব কিছুই মানুষ জানে। সমপ্রতি মঠবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বেতমোড় এলাকার এক মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী চিকিত্সার জন্য জনৈক ডাক্তারের কাছে আসেন। ডাক্তার সাহেব তার হাতে ব্যবস্থাপত্র দেয়ার পরপরই ৪-৫ জন দালাল তাকে ঘিরে ফেলে এবং বলে, আপা আমার সাথে আসেন কম টাকায় পরীক্ষা করে দেব। ওই ভদ্রমহিলা বিরক্ত হয়ে এক পর্যায়ে নিজেই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চলে গেলেন।
৭-৮ বছর আগের একটি ঘটনা না বললেই নয়। একদিন সকালবেলা মঠবাড়িয়া হাসপাতালে গেলাম। গিয়ে দেখি হাসপাতালের পরিবেশ খুব সুন্দর। হাসপাতালে প্রধান গেটের সামনে সব সময় ওষুধ কোম্পানিসহ বিভিন্ন লোকের গাড়ি পার্কিং করা থাকে। ওই দিন সব ফাঁকা। এরই মধ্যে মাজেদ নামে হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারী বলে উঠল, ভাই আজকের পরিবেশটা কেমন মনে হচ্ছে! আমি উত্তরে বললাম, ভালো। কারণ জানতে চাইলে সে বলল, গতদিন তার সাথে ওষুধ কোম্পানির এক প্রতিনিধির সাথে ঝগড়াঝাটি হয়েছে। তাই দালাল ও ওষুধ কোম্পানির লোকজনকে হাসপাতাল চত্বর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর হুঙ্কারে যদি হাসপাতাল দালাল ও ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভমুক্ত হয়, তাহলে চিকিত্সকদের পক্ষে হাসপাতালকে দালালমুক্ত করা কি সম্ভয় নয়? যদি না হয়, তাহলে দালালদের জন্য হাসপাতাল চত্বরে কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হোক।
আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানই চলে শিডিউল মাফিক। এমনকি হাসপাতালও। কোন ডাক্তার কখন কোন ডিউটি করবেন এ জন্য তারা প্রতিমাসে রোস্টার তৈরি করেন। ওই রোস্টারে লিপিবদ্ধ থাকে সপ্তাহের কোন দিন কোন ডাক্তার মর্নিং, ইভিনিং ও নাইট ডিউটি করবেন। আর রোস্টার অনুযায়ী ডাক্তার ও উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসাররা ডিউটি পালন করে থাকেন। এই রোস্টার পদ্ধতি ছাড়া ডাক্তারা যদি সবাই একই সময় ডিউটি করতে চাইতেন তাহলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতো। ঠিক তেমনিভাবে দালালদের হাসপাতাল চত্বরে কক্ষ বরাদ্দ দিয়ে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা হোক। ওদেরকেও রোস্টার পদ্ধতি অনুযায়ী ডিউটি ভাগ করে দেওয়া হোক। তাহলে একজন রোগীকে আর পাঁচজন দালালে টানাহ্যাঁচড়া করবে না। আর বেতমোড় এলাকার ওই মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর মতো দালালদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগও করবেন না। দালালদের এ ধরনের ভিডিওচিত্র আর দেখতে হবে না।
লেখক : মঠবাড়িয়া উপজেলা প্রতিনিধি, দৈনিক বাংলাদেশ সময়।